ডলারের দাম এখন বাজার ব্যবস্থা হতে ঠিক হবে

বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ইস্যুতে গত কয়েক মাস ধরেই আইএমএফের সঙ্গে দরকষাকষি করে আসছিল সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বুধবার (১৫ মে, ২০২৫) দুপুরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। একই সঙ্গে আগামী মাস তথা জুনের মধ্যেই আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তিসহ ৩৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। 

গবর্ণর বলেন, আইএমএফের ঋণ চুক্তির শর্ত ছিল ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এর আগে এ বিষয়ে তাগাদা দেয়া হলেও আমরা বলেছি, আমাদের অর্থনৈতিক পরিবেশ ও সামগ্রিক স্থিতিশীলতা পর্যাপ্ত হয়নি। বিনিময় হার বাজারের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দিতে আমরা প্রস্তুত নই। কিন্তু এখন মনে করছি, আমাদের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক স্থিতিশীল হয়েছে। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে আমরা প্রস্তুত।

গভর্নর আরো বলেন যে, দেশের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে । সরকারের চলতি হিসাব ও ব্যালান্স অব পেমেন্ট, আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে । বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে ঝুঁকিমুক্ত অবস্থানে উঠেছে। গত নয় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে কোনো ডলার বিক্রি করেনি। বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আগামী ১০ মাসেও বিক্রি করতে হবে না । বর্তমান বাজার আমাদের সমর্থন করবে। কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই গত নয় মাসে যেভাবে ডলারের বাজার স্থিতিশীল ছিল, আগামীতেও কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

কোনো কারণে বাজার অস্থিতিশীল হলে সেটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫০ কোটি ডলারের একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে । প্রয়োজন হলে এ তহবিল থেকে ডলার বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা জানানো হয়।

দেশের ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে প্রায় চার বছর ধরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারিতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। এর পর থেকেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চরমে ওঠে। মাত্র এক বছর পর ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০৩ টাকায় ঠেকে। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। জুনে এসে বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এক ধাক্কায় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১৮ টাকায় ঠেকে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বিনিময় হার আরো বেড়ে ১২০ টাকায় স্থির হয়। আর সর্বশেষ গতকাল (১৪ মে, ২০২৫ ) ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের দর ছিল ১২২ টাকা।

এদিকে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ঘোষণায় ব্যাংক খাতের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) গতকাল ডলারের দর কিছুটা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেলা ২টার পর এ ঘোষণা আসায় অবশ্য খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এ ঘোষণার ফল পেতে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । গতকালের ঘোষণার পর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ১২৬ টাকা পর্যন্ত ওঠে বলে প্রকাশ হয়েছে।। আর ব্যাংক খাতে ডলারের দর বেড়েছে  প্রতি ডলারে ২০—৩০ পয়সা। ব্যাংকগুলো গতকাল রেমিট্যান্স সংগ্রহে প্রতি ডলার ১২২ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে।

আমাদের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, এডিবি, এআইআইবি ও জাইকা। এসব সংস্থা আমাদের বলেছে, আইএমএফ থেকে ঋণের কিস্তি প্রাপ্তির চিঠি পাওয়ার পরপরই তারা তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করবে। আমরা মনে করি, জুনের মধ্যেই সব উন্নয়ন সহযোগীর ঋণ ছাড় হয়ে যাবে। সে হিসাবে আগামী মাসেই আমরা ৩৫০ কোটি ডলার সহায়তা পাচ্ছি। এ অর্থ যোগ হলে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে যাবে।

মানুষ বাজার থেকে যে দরে চাল কিনছে সেটি কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি। কোনো বিক্রেতা চাইলেই চালের কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে পারছে না। আপনারা ৮০ টাকা দরেই চাল কিনতে পারছেন। চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতেই চালের দাম নির্ধারণ হচ্ছে। ডলারের বিনিময় হারও সেভাবে নির্ধারিত হবে। বাজার বাজারের মতোই চলবে। কেউ চাইলেই ডলারের দাম অনেক বেশি দাবি করতে পারবে না। আমরা মনে করছি, উন্মুক্ত করে দেয়ার পরও ডলারের বিনিময় হার বিদ্যমান দরের আশপাশে থাকবে।

দেশের রেমিট্যান্সের বাজার এখন এগ্রিগেটর বা বড় কিছু এক্সচেঞ্জ হাউজ নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের ছোট এক্সচেঞ্জ হাউজের সংগৃহীত রেমিট্যান্স এগ্রিগেটররা কিনে নেয়। এরপর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ডলারের দর নিয়ে দরকষাকষি করছে। গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের বিনিময় হার এ দেশের মাটিতেই ঠিক হবে। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারই সেটি নির্ধারণ করবে। দুবাই বসে কেউ বিনিময় হার নির্ধারণ করলেই সেটি মানা হবে না। এগ্রিগেটরদের দরকষাকষির কিছু ক্ষমতা আছে। তবে সেটি সর্বোচ্চ পাঁচ সাতদিন । কারণ প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগৃহীত রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠাতেই হবে। অযৌক্তিক দরে এগ্রিগেটরের কাছ থেকে ডলার কেনার দরকার নেই। গভর্ণর বলেন, আমরা চাই, ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যেই ডলার বেচাকেনা করুক। আন্তঃব্যাক ডলারের বাজার সচল হোক।

এখন সব বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনার পর একমত হয়েছি এবং বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছি। অপরিপক্ব কোনো ঘোষণা আমরা দিইনি। আমি এখনো বলছি, আইএমএফের ঋণের কিস্তি না পেলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় কোনো ক্ষতি হবে না।

দেশের ব্যাংক খাতের সংস্কার, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক রেজল্যুশনসহ নানা বিষয়েও কথা বলেন গভর্নর। গভর্ণর বলেন,  ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছি। এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর গভর্ন্যান্স ঠিক করা। আগে এ ব্যাংকগুলোর যে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা ছিল তারা গভর্ন্যান্সের বিষয়ে আন্তরিক ছিল না। আমরা খেলাপি ঋণ গণনায় আন্তর্জাতিক চর্চায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এতদিন খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন প্রকাশ হচ্ছে তাই খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ব্যাংকগুলোকে আমরা বলেছি, খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ না করা পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ১ পয়সার ডিভিডেন্ডও ঘোষণা করতে পারবে না।

আগামীতে কোনো ব্যাংকের পর্ষদ উল্টাপাল্টা কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেন গভর্নর। তিনি বলেন, অনিয়ম ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে।  সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ জারি করেছে। এ আইনে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে , দুর্বল ব্যাংককে সাময়িক সময়ের জন্য সরকারের মালিকানায় নিয়ে আসা যাবে।  মালিকদের স্বার্থ রক্ষা নয়, বরং আমানতকারীদের স্বার্থেই এটি করা হবে।

আমানতকারীদের কোনো ভয়ের কারণ নেই, বাংলাদেশ ব্যাংক আপনাদের সঙ্গে আছে। আমরা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করব । এতে আমানতকারীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কোনো আমানতকারী টাকা হারাবেন না। আপনারা যে ব্যাংকে আমানত রেখেছেন, আপাতত সেখানেই রাখুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।

সংবাদটি দৈনিক ইত্তেফাক হতে সংগৃহীত । বিস্তরিত জানতে এখানে ক্লিক করুণ